মো. সফিকুল ইসলাম মোল্লা, কচুয়া (চাঁদপুর) প্রতিনিধি : চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থান রয়েছে, যা অনেকেরই অজানা। আবার জানা থাকলেও অনেকেই সেখানে যেতে পারেননি। এর মধ্যে রয়েছে সাচারের জগন্নাথ দেবের রথ, মনসামুড়া মন্দির, উজানীর বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের পাঠা পুতার দীঘি আর চাঁদ সওদাগরের ডুবে যাওয়া সাম্পান, শুয়ারোলের কানুখা রাজার দীঘি। এসব ধর্মীয় স্থান চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় বহুকাল ধরেই রয়েছে। মনসামুড়াটি উপজেলার মেঘদাইর গ্রামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কচুয়া বাজার থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে গৌরিপুর-কচুয়া-হাজীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাশে সাচার ইউনিয়ন পরিষদ। ওই ইউনিয়নের সাচার বাজারে জগন্নাথ দেবের মন্দির অবস্থিত। এ মন্দিরে বহুকাল ধরেই আষাঢ়ের জগন্নাথ, বলরাম, শুভদ্রার প্রতিমূর্তি স্থাপন করে প্রথম “রথযাত্রা” ও ফিরতি “রথযাত্রা” অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ রথযাত্রায় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত থেকে আসা অসংখ্য ভক্তের সমাগম ঘটে। আষাঢ় মাস আসলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় সাচারে। আর দ্বিতীয় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ে। এটি বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ রথযাত্রা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে সাচারের রথটিতে দাপট, ত্রেতা, কলি যুগের বহু নির্দশন কাঠের খোদাই করা নকশা শোভাবর্ধন করেছিল। কিন্তু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী সৌন্দর্যমন্ডিত রথটি পুড়িয়ে ফেলে। পোড়া ধ্বংসাবশেষ নিয়ে স্বাধীনতার পর রথটি টানা হতো। এখানে আষাঢ়ের রথযাত্রায় সাচারে কয়েক লাখ ভক্তের সমাগম ঘটে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্তরা সাচারের রথটিকে তাদের পূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে মনে করেন। তাইতো তারা রথযাত্রা এলে সাচারের জগন্নাথ মন্দিরে ছুটে আসে। সাচার জগন্নাথ মন্দিরটি ঘিরে আরো তিনটি মন্দির রয়েছে। এগুলো হলো দুর্গা মন্দির, লোকনাথ ও কালী মন্দির।
সাচারের জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত শান্তি চক্রবর্তীর সাথে কথা হয় রথের উৎপত্তি সম্পর্কে। তিনি জানান, ১২৭৭ বঙ্গাব্দে চাঁদপুরে কচুয়া উপজেলার সাচারের রথের প্রতিষ্ঠা। আর রথের উৎপত্তি এমনিভাবেই হয়। ত্রিপুরা থেকে গঙ্গা গোবিন্দ সেন তীর্থযাত্রায় যান জগন্নাথ মন্দিরের দর্শনে। তখন ঠাকুর বাঁধা দেন, তার দর্শন না পাওয়ার জন্য। রাগে-ক্ষোভে ঠাকুর মন্দিরে প্রবেশ করলে আপনা-আপনি দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি সেবককে বলেন ত্রিপুরা থেকে যে ব্যক্তি এসেছেন আমি তাকে দর্শন দেব না, বলে দাও। সেবক গঙ্গা গোবিন্দ সেনকে গিয়ে ঠাকুর দর্শন না দেওয়ার কথা বলেন। তখন গঙ্গা গোবিন্দ সেন ঠাকুর দর্শনে যাবেনই। ঠাকুর তোমাকে কেন নিষেধ করতে পাঠিয়েছে। গঙ্গা গোবিন্দ সেনের বাঁধা না শুনে ঠাকুরের দর্শনে যান, গিয়ে দেখেন মন্দিরের দরজা বন্ধ। তখন তিনি প্রণাম করে মন্দিরের সামনে ৪/৫ দিন ধরে পড়ে থাকেন। জগন্নাথ দেব বলে দেন, আমি তোমাকে দর্শন দেব না। তোমার বাড়িতে গিয়ে দর্শন দেব। গঙ্গা গোবিন্দ সেন বলেন, বাড়িতে যাবে তার প্রমাণ কি? তখন ঠাকুর বলেন জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শুক্লপক্ষে স্থান “রথযাত্রায়” যাব, তখন চন্দন বৃষ্টি হবে। আর সেসময় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আমাকে নিবে। ঠাকুরের কথামতো চন্দন বৃষ্টি হয়, নিম কাঠের টুকরো সাচার খালে ভেসে বটবৃক্ষের নিচে এসে থামে। ঠাকুর নিজে আসেনি, তবে প্রমাণটুকু গঙ্গা গোবিন্দ সেনকে দেখিয়েছেন। গঙ্গা গোবিন্দ সেন ওই নিমের কাঠটুকু সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যান। ওইদিন সন্ধ্যায় একজন মিস্ত্রি আসে। গঙ্গা গোবিন্দ সেনকে ডেকে বলেন, তুমি নাকি ঠাকুর তৈরি করবে? তখন তিনি স্থান দেন ঠাকুর তৈরির জন্য। এসময় একটি ঘরে মিস্ত্রি কাঠ নিয়ে প্রবেশ করলে গঙ্গা গোবিন্দ সেন ভেতরে এবং বাহিরে দুটি তালা লাগিয়ে দেন। ঠাকুর তৈরিতে ভেতরে প্রবেশ করা মিস্ত্রির খাবার-দাবার ও প্রবেশের কোন খবর ছিল ন। হঠাৎ কয়েকদিন পর গঙ্গা গোবিন্দ সেন দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন ঠাকুর তৈরির কাজ শেষ। কিন্তু মিস্ত্রি ভেতরে নেই। এভাবে এ রথযাত্রা উৎপত্তি হয়। আর এই উৎপত্তির পর ১২৭৭ বঙ্গাব্দ থেকে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সাচারের জগন্নাথ মন্দিরে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে রথযাত্রা উৎযাপিত হয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যাওয়া রথটি তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ.ন.ম এহছানুল হক মিলন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় নতুনভাবে এটিকে নির্মাণ করে দেন। যার ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে সাবেক শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী আ.ন.ম এহছানুল হক মিলনের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, আমি একবার মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ের রথে গিয়েছিলাম ওই রথটি আমায় মুগ্ধ করেছে। যার জন্য আমি সাচারের রথটি পুনরায় নির্মাণের জন্য ভারত থেকে কারিগর এনে তৈরি করেছি। সারা দেশের হিন্দু ধর্মীয় মানুষ এখানে তাদের ধর্মীয় পূজা অর্চনা করতে পারে। আমি চেয়েছিলাম এটিকে হিন্দুদের মহা তীর্থস্থান করতে। যারা মন্দিরের জায়গা দখল করেছে তা উদ্ধার করতে চেয়েছিলাম। এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। যার জন্য ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে প্রথমে ২০ লাখ টাকায় এটি নির্মাণ শুরু করি। পরবর্তীতে এটি ৪০ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। শুধু তাই নয়, রথটি রাখার জন্য ঘর নির্মাণে ২২ বান ঢেউটিন দিয়েছিলাম। একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে মন্দির নিয়ে মিথ্যাচার করছিল। একজন এমপি হিসেবে কোন প্রতিষ্ঠানকে সর্বস্ব ২৫ বান টিন দেয়া যেতে পারে। পরবর্তীতে ১১ জন দুস্থ পরিবারকে টিন দেয়া হয়। তারা এ টিনগুলো মন্দিরে দান করে দেয়।
সাচার জগন্নাথ মন্দিরটি এখন নিজস্ব অর্থ ও বিভিন্নজনের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। এ জগন্নাথ মন্দির পরিচালনার জন্য একটি কমিটিও করা হয়েছে। এ কমিটির মাধ্যমে আজ ৭ জুলাই রোববার হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা সাচারে অনুষ্ঠিত হবে।