চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি
আজ ২০ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এইদিনে পাবনার সবচেয়ে প্রাচীন ও হিন্দু বধিষ্ণু জনপদ চাটমোহর পাকিস্তানী হানাদারদের দখল মুক্ত করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অবশ্য তার আগেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয় প্রায় সারাদেশে। কিন্তু চাটমোহরে তখনো হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ৭১’ সালের এপ্রিল মাসে হানাদাররা দু’দফায় পাবনায় প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে পরে। মে মাসে ফের তারা আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে পাবনা দখল করে নেয় নগরবাড়ীঘাট দিয়ে ঢুকে। এরপর হানাদাররা ১৩ মে চাটমোহর দখল করে নেয়। তার আগে পাবনা থেকে এসে হানাদাররা প্রাচীন জনপদটি আগুন দিয়ে ঝলসে দেয়। ব্যাংক লুট করে। ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ খান ও ক্যশিয়ার শামসুল ইসলাম সহ দু’জন গার্ডকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর হানাদাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বড়বাড়ীর (বর্তমান জিরোপয়েন্ট) রঘুনাথ কুন্ডু, পুরাতন কৃষি ব্যাংকের পূর্বপাশের অশ্বিনী কুন্ডু, ঝরুঠাকুর ও নতুন বাজারের যতীন কুন্ডুকে গুলি করে হত্যা করে তাদের বাড়ীতে গিয়ে। গঠিত হয় শান্তি কমিটি। সভাপতি ফয়েজ আহম্মেদ খাঁন হন প্রথম শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি শুরুতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ধর্মান্তারিত করেন জোরপূর্বক। সংখ্যালঘুদের উপর চলতে থাকে নির্মম জুলুম-অত্যাচার ও নারী নির্যাতন। পরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হন মো. নূরুজ্জামান এর নেতৃত্বে রাজাকারদের অত্যাচার-নির্যাতন, লুটপাট বেড়ে যায়। প্রথম কয়েকদিনের জন্য শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন মরহুম ময়েন উদ্দিন মোল্লা। তিনি কোন কিছু করেননি। এভাবেই সাড়ে সাত মাস চাটমোহর পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের দখলে থাকে। ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা ছোট-ছোট আক্রমণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল দিয়ে চাটমোহর শহরকে ঘিরে ফেলতে থাকে। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম থানা আক্রমণ করেন। সেসময় কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজ, ইদ্রিস আলী চঞ্চল, আমজাদ হোসেন লাল এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে হানাদাররা থানায় আটকা পড়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর রাতে এক আক্রমণের মুখে দুর্ধর্ষ পাকসেনা শের আফগানসহ বেশ ক’জন মিলিশিয়া হানাদার নিহত হয়। এর আগের দিন ১৪ ডিসেম্বর ভোরে বারংবার জয় বাংলা শ্লোগান শুনে বিলচলন ইউনিয়নের (অধুনালুপ্ত চাটমোহর ইউনিয়ন) মেহের উদ্দিন মোল্লার ২ ছেলে মোসলেম ও তালেব ধারণা করেন বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এসময় তারা চাটমোহর ডাক বাংলা এলাকায় বড়াল নদের পাড়ে অবস্থান করছিলেন। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে তারা থানার সামনের রাস্তায় চলে আসলে থানার ভেতর থেকে পাকবাহিনী প্রকাশ্যে দিনের বেলা বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমপে¬ক্সের পেছনে বটগাছের নীচে বড়াল নদীপাড়ে দাঁড় করিয়ে দুই-ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর অবস্থা বেগতিক বুঝে হানাদাররা থানায় সাদা পতাকা উড়িয়ে ফ্লাগ মিটিং এর আহ্বান জানায়। এ অবস্থায় দুইদিন আক্রমণ বন্ধ থাকে। ১৮ ডিসেম্বর হানাদারদের আহহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা থানায় প্রবেশ করে আলোচনায় বসেন। হানাদাররা মুক্তিবাহিনী নয়, মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের শর্ত দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা আক্রমণ বন্ধ রেখে ২০ ডিসেম্বর পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুলকে মিত্রবাহিনীর পোষাক পরিয়ে নকল মিত্রবাহিনী সাজিয়ে চাটমোহরে নিয়ে আসেন। এদিন দুপুর ২টায় তার কাছেই হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই বিজয় দিবসের ৪ দিন পরে ২০ ডিসেম্বর চাটমোহর হানাদার মুক্ত হয়।
