মৌসুমের শুরুতেই পূর্বধলার শ্যামগঞ্জে সরকারি মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি হচ্ছে

পূর্বধলা (নেত্রকোণা) প্রতিনিধি
নেত্রকোণার পূর্বধলা ও গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জ বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিসিআইসি ডিলার বিএডিসি ডিলার, সাব ডিলারসহ খুচরা পর্যায়ে সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইউরিয়া, এমওপি, ডিএপি (বাংলা), টিএসপিসহ সব ধরনের সার ২০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছে ডিলার ও সার ব্যবসায়ীরা।
ইরি-বোরো মৌসুমের শুরুতেই কৃষকদের জিম্মি করে এক শ্রেণির মুনাফা লোভী ডিলাররা সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রকারভেদে একশত টাকা থেকে ৪/৫শত টাকা বেশি দামে এসব সার বিক্রি করছে। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ডিলাররা বেশি দামে সার বিক্রি করলেও স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করায় কৃষকদের মাঝে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর উপজেলার মোট ২১ হাজার ৭৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে ৬ হাজার ৫শত হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ও ১৫ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে উফশী চাষাবাদ করা হবে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন। এছাড়া উপজেলায় সরিষা চাষাবাদ করা হয়েছে ১৪ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে।
কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শফিফুল ইসলাম জানান, ইরি-বোরো মৌসুম শুরুর আগেই উপজেলা কৃষি বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলার ডিলারদের সাথে কয়েক দফা মিটিং করে বলা হয়েছে যেন তারা সরকারের নির্ধারিত দামের বাইরে বেশি দামে সার বিক্রি না করেন। কিন্তু যেই সেই। ডিলাররা সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামেই সার বিক্রি করে আসছে।
কৃষকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে বেশি দামে সার বিক্রি করে আসলেও কৃষি বিভাগ এখনও এ ব্যাপারে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এছাড়া সারা উপজেলায় কৃষি বিভাগের কোন মনিটরিং না থাকায় ডিলাররা সারের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে।
গত দুইদিন শ্যামগঞ্জ বাজারে বিভিন্ন ডিলারদের দোকানে মনিটরিং করে দেখা যায়, কৃষকরা বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ ডিলাররা সিন্ডিকেট তৈরী করে এক রেটে তা বিক্রি করছে।
শ্যামগঞ্জসহ বিভিন্ন হাট-বাজারে ইউরিয়া প্রতিবস্তা সরকারি মূল্য ১১শত টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১১/১২ শত টাকা, ডিএপি যার সরকারি মূল্য ৮শত টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১৩/১৫শত টাকা, এমওপি (লাল সার) সরকারি মূল্য ৭৫০ টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ১১শত টাকায়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, পূর্বধলা উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের জন্য বিসিআইসি ডিলার ১৮ জন, বিএডিসি ডিলার ২৬ জন এবং সাব ডিলার রয়েছেন ১০৭ জন।
ডিলারদের নিজ নিজ ইউনিয়নে সার বিক্রির নিয়ম থাকলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে অল্প সংখ্যক মাল পাঠিয়ে শ্যামগঞ্জ বাজারেও দোকান খুলে মাল বিক্রি করছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন শ্যামগঞ্জ বাজারটি তিন উপজেলা পূর্বধলা, গৌরীপুর ও তারাকান্দা উপজেলার মোহনা এবং এই তিন উপজেলার কৃষক সার কিনতে শ্যামগঞ্জ বাজারে আসে। তাদের কাছে খুব সহজে বেশি দামে সার বিক্রি করতে পারে ডিলাররা। কারণ তারা অন্য উপজেলা বা অন্য ইউনিয়নের কৃষক। দাম নিয়ে তারা প্রতিবাদ করলে তাদের কাছে সার বিক্রি করা হবে না বলে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে তারা কোন রকম প্রতিবাদ না করে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হয়। ডিলার, সাব ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ী এ তিন হাত ঘুরে কৃষক পর্যায়ে গিয়ে প্রতি বস্তা সারের দাম বাড়ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। পূর্বধলা কৃষি বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের মনিটরিং না থাকায় কৃষকদের ঠকিয়ে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। এছাড়া ছোট ছোট হাটবাজারগুলোতে আরো অনেক বেশি দামে সার বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ইতিমধ্যে দুইজন সার ব্যবসায়ীকে বেশি দামে সার বিক্রি করার অপরাধে জরিমানা করা হলেও তাতেও বন্ধ হচ্ছেনা বেশি দামে সার বিক্রি। ডিলার, সাব ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কেউই ক্রেতাদের রশিদ দিচ্ছে না। রশিদ চাইলে নানা অজুহাতে তাদের কাছে সার বিক্রি করছে ডিলাররা। আরো অভিযোগ রয়েছে, শ্যামগঞ্জ বাজারে একজন ডিলারই আরো দুইজন ডিলারের মাল তুলে তা বিক্রি করছেন। অপরদিকে বিসিআইসি ডিলার ও বিএডিসি ডিলার একই ব্যক্তি।
কৃষকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইউরিয়া সার সাড়ে ১১শত টাকা, ডিএপি সার ১৩শত টাকা এবং এমওপি সার ১১শত টাকা দরে বিক্রি করেছে। সরকারি মূল্যে তারা আমাদেরকে সার দেয়নি। আর রশিদ চাইলে সার বিক্রি করে না।
শ্যামগঞ্জ বাজারের বিসিআইসি ডিলার হুমায়ুন কবির জানান, আমরা ঠিকমত বরাদ্দ পাই না। বাইরে থেকে বেশি দামে সার কিনে আনতে হয় ফলে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। ডিএপি সার সাড়ে ১৩শত টাকা বিক্রি করা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ডিএপি (রাঙ্গাদিয়া-চট্টগ্রাম) এই সার আমরা বরাদ্দ কম পাই। ফলে চট্টগ্রাম থেকে বেশি দামে কিনে আনতে হয় বিক্রিও বেশি দামে করতে হয়। মোঃ হুমায়ুন কবির নিজের ডিলারশীপসহ আরো দুইজন ডিলারের মাল উত্তোলন করে বিক্রি করে আসছে।
অপরদিকে বিসিআইসি ও বিএডিসি ডিলার মুখলেছুর রহমান জানান, ডিএডি সার গত বছর সাড়ে ১৮শত টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এবার সাড়ে ১৩শত টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে শুনে সরকার খুশি হবেন বলে তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে মন্তব্য করেন। বরাদ্দের ব্যাপারে তিনি বলেন, ডিএডি রাঙ্গাদিয়া সার আমরা বরাদ্দ পাই মাত ৮/১০ বস্তা। তাই বাইরে থেকে বেশি দামে কিনে আনতে হয়।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, ইরি-বোরো মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে উপজেলার সকল সার ডিলারদের নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিটিং করে সকল সার ডিলারদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করা যাবে না। সারের কোন ঘাটতি নেই পর্যাপ্ত সার বরাদ্দ পাচ্ছে ডিলাররা। তারপর তারা বেশি দামে সার বিক্রি করছে আমাদের উপ-সহকারি কৃষি অফিসারদের কাছে জানতে পারলাম। তবে এ ব্যাপারে ইউএনও স্যারকে নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষি অফিসার আরো জানান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরকে নজরদারি করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হাছান প্রিন্স জানান, যারা সরকারি নিয়ম অমান্য করে বেশি দামে সার বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বেশি দামে সার বিক্রির অপরাধে দুইজন সার ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে।